১. ভূমিকা
মাছ ও চিংড়ি শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণি অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে চাষকৃত পুকুর ও ঘের দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পেয়ে সংকট সৃষ্টি করে। এ পরিস্থিতিতে মাছ ও চিংড়ির প্রাকৃতিক খাদ্য নষ্ট হয় এবং অধিক পঁচনজনিত ক্ষতিকারক গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তাপপ্রবাহ বা তাপদাহে মাছ ও চিংড়ির অস্বস্তি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিপাক ক্রিয়া, প্রজননচক্র, খাদ্য গ্রহণ ও বৃদ্ধির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে মাছ ও চিংড়ি তাপীয় পীড়ন (থার্মাল শক)-এ আক্রান্ত হয় এবং পানির বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলী পরিবর্তিত হয়ে মাছ ও চিংড়ির মড়কের কারণ হতে পারে। তাই মৎস্য ও চিংড়ি চাষিদের জন্য সঠিক পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ এবং ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. তাপপ্রবাহে পুকুর ও ঘেরে পানির গুনাগুণের পরিবর্তন:
- তাপপ্রবাহে পুকুর ও ঘেরে পানির তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে গিয়ে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়।
- জৈব পদার্থের পঁচন বৃদ্ধি পেয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
- শ্যাওলার স্তর পড়ে।
- পুকুর ও ঘেরের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
- পানির পিএইচ পরিবর্তিত হয়ে মাছ ও চিংড়ির স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
৩. মাছ ও চিংড়ির ওপর তাপপ্রবাহের প্রভাব:
- মাছ ও চিংড়ি পানির ওপরে উঠে খাবি খায় এবং বিক্ষিপ্তভাবে চলাফেরা করে।
- প্রাথমিকভাবে খাদ্য গ্রহণের প্রবনতা বেড়ে গেরেও চূড়ান্ত পর্যায়ে খাদ্য গ্রহণ কমে যাওয়ার ফলে মাছ ও চিংড়ি দূর্বল হয়ে যায়।
- মাছ ও চিংড়ির বিপাক ক্রিয়া বেড়ে যায় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে দূর্বল হয়ে যায়।
- মাছ ও চিংড়ি ক্ষতিকর অনুজীব দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- রোগের প্রকোপ বাড়ে, যা উৎপাদন ব্যাহত করে।
- তাপীয় পীড়ন (থার্মাল শক) ও হিট স্ট্রোকে মাছ ও চিংড়ি মারা যায়।
৪. তাপপ্রবাহে মাছ ও চিংড়ির মৃত্যু কমানোর উপায়
৪.১ পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুনাগুণ বজায় রাখুন:
- পুকুর ও ঘেরে পানির তাপমাত্রা কমাতে এবং প্রয়োজনীয় গভীরতা বৃদ্ধি করতে দুপুরের পর ভূগর্ভস্থ সাব-মারসিবল পাম্প অথবা পার্শ্ববর্তী উৎস্য যেমন-নদী, খাল ও বিল হতে নিরাপদ ও অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা পানি ঝর্ণাকারে সরবরাহের মাধ্যমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন ও পানির প্রয়োজনীয় গভীরতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। অথবা, প্রয়োজনে পুকুর/ ঘের/ জলাশয়ের কিছু পরিমাণ পানি বের করে ভূগর্ভস্থ পানি যোগ করুন।
- প্রয়োজনে পুকুর ও ঘের হতে আনুমানিক ২০% পানি বের করে ভূগর্ভস্থ পানি যোগ করতে পারেন।
- পুকুর ও ঘেরে পানি পরিবর্তনের লক্ষ্যে যথাযথ প্রবেশ ও নির্গমন ব্যবস্থা (ইনলেট ও আউটলেট) স্থাপন করতে হবে।
- পুকুর ও ঘেরে অ্যারেটর বা ফোয়ারা সংযোজন করলে তা পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন বৃদ্ধির পাশাপাশি তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করবে। দুপুরের পর অন্তত: ১ ঘন্টা এবং ভোরে কমপক্ষে ২ ঘন্টা করে অ্যারেটর চালিয়ে অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ করা যায়। অথবা, পাম্প মেশিনের মাধ্যমে পুকুরের পানি ঝর্ণার মতো আন্দোলিত করে অক্সিজেনের যোগান দেওয়া যায়।
- অ্যারেটর ব্যবহার করা সম্ভব না হলে অক্সিজেনের ঘাটতি মোকাবিলায় অক্সিজেন ট্যাবলেট (প্রতি শতকে প্রতি ফুট পানির গভীরতায় ১ টি) অথবা নির্দেশিত মাত্রায় অক্সিজেন পাউডার ব্যবহার করতে হবে।
- পুকুর ও ঘের যত গভীর হবে, ততই পানির তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকবে। তাপপ্রবাহে পুকুরের উপরের স্তরের পানি গরম হয়, কিন্তু গভীরে ঠান্ডা পানি থাকে। তাছাড়া, মাছ ও চিংড়ির বিচরণের পরিধি বেশি হওয়ায় পীড়ন (স্ট্রেস) কম হয়। তাই পুকুরের গভীরতা ৬-৭ ফুট হওয়া উচিত।
- পুকুর ও ঘেরের একপাশে আনুমানিক ১০% জায়গায় কচুরিপানা বা ভাসমান জলজ উদ্ভিদ রেখে ছায়াযুক্ত স্থান তৈরি করা যেতে পারে, যাতে তাপপ্রবাহের সময় মাছ ও চিংড়ি নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। উল্লেখ্য যে, কচুরিপানা বা জলজ উদ্ভিদ যাতে পুকুর ও ঘেরে ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- পুকুর ও ঘেরের পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুনাগুণ যেমন- তাপমাত্রা (২৫-৩০০C), অক্সিজেন (৫.০-৭.০ মিগ্রা/লিটার), পিএইচ (৭.৪-৮.৫), স্বচ্ছতা (২৫-৪০ সেন্টিমিটার), অ্যামোনিয়া (০.০৫ মিগ্রা/লিটার) ইত্যাদির মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
- তাপদাহ চলাকালীন প্রতি ১৫ দিনে একবার করে ভোরে প্রতি শতাংশে ১০০-২০০ গ্রাম চুন এবং বিকালে ১০০-২০০ গ্রাম লবণ প্রয়োগ করুন।
- তাপদাহ চলাকালীন পুকুর ও ঘেরে ইউরিয়া অথবা ইউরিয়া জাতীয় সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
- দিনের বেলায় জাল বা হররা টেনে পুকুর ও ঘেরের তলদেশের দূষিত গ্যাস বের করে দিতে হবে।
- পুকুর ও ঘেরের তলদেশ হতে অতিরিক্ত কাঁদা এবং পচনশীল দ্রব্য থাকলে অপসারণ করতে হবে।
- সম্ভব হলে পুকুর ও ঘেরের চাষকৃত মাছ ও চিংড়ির মজুদ ঘনত্ব কমাতে হবে।
- উপযোগিতা থাকলে পুকুর ও ঘেরের পাড়ে সবজি এবং পুকুর ও ঘেরের উপরে মাঁচা তৈরি করে ছায়াযুক্ত ঠান্ডা জায়গা তৈরি করা যেতে পারে।
- চিংড়ির ক্ষেত্রে নার্সারি পয়েন্টের উপর ছাউনি স্থাপন করতে হবে।
৪.২ পুকুর ও ঘেরে খাদ্য সরবরাহে সতর্কতা:
- তাপদাহের সময় মাছ ও চিংড়ি খাবার কম খায়। তাই খাদ্য ব্যবস্থাপনায় অপচয় রোধকল্পে মাছ ও চিংড়িকে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি মাছ ও চিংড়ির খাদ্য গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
- প্রয়োজনে মাছ/ চিংড়ির জন্য দৈনিক খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ অর্ধেক কিংবা অবস্থাভেদে আনুপাতিক হারে কমানো। অধিক তাপদাহের সময় খাদ্য প্রয়োগ পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।
- সকালে ও সন্ধ্যায় ঠান্ডা পরিবেশে খাবার দিতে হবে। দিনের মাঝামাঝি সময়ে খাবার দেওয়া এড়িয়ে চলুন, কারণ এ সময় তাপমাত্রা বেশি থাকে।
- তাপপ্রবাহের সময় প্রোটিনসমৃদ্ধ সহজপাচ্য খাদ্য দেওয়া উচিত। অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন, কারণ এটি মাছ/ চিংড়ির জন্য হজম করা কঠিন।
- খাবারের সঙ্গে ভিটামিন-সি এবং ভিটামিন-ই যোগ করতে পারেন। এগুলো মাছ/ চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- তাপদাহ চলাকালীন প্রতিদিন প্রতি শতাংশে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় উপাদান (আটা/ চাল/ ভূট্টার কুড়া ইত্যাদি) ৫০-১০০ গ্রাম করে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- এছাড়া খাদ্য প্রদানের ক্ষেত্রে অটোমেটিক ফিডার ব্যবহার করা যেতে পারে এবং দৈনিক নির্ধারিত সময়ে ও নির্ধারিত স্থানে খাবার প্রদান করতে হবে।
৫. তাপপ্রবাহ মোকাবিলার প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থাপনা
৫.১ জরুরি সরঞ্জাম মজুদ রাখুন:
- অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করার উপকরণ যেমন- অ্যারেটর, সাবমার্সিবল পাম্প, ব্লোয়ার, এবং অক্সিজেন ট্যাবলেট ইত্যাদি।
- পানির গুনাগুণ পরীক্ষার সরঞ্জাম যেমন- পিএইচ মিটার, ডিও মিটার, এমোনিয়া টেস্ট কীট, থার্মোমিটার, সেকি ডিস্ক ইত্যাদি।
- পানি জীবাণুমুক্ত ও মাছ/ চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় পটাসিয়াম পারম্যাংগানেট মজুদ।
- পানির জীবাণু দূরীকরণ এবং পিএইচ ঠিক রাখার জন্য চুন মজুদ।
- পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ব্যাকআপ জেনারেটরের ব্যবস্থা।
- জরুরি যোগাযোগের লক্ষ্যে উপজেলা মৎস্য অফিসারের টেলিফোন/ সেলফোন নম্বর সংরক্ষণ।
৫.২ তাপপ্রবাহ সহনীয় মাছ/ চিংড়ির চাষ ও পুকুর/ ঘের/ জলাশয়ের ডিজাইন:
- তাপপ্রবাহে সহনশীল মাছ যেমন তেলাপিয়া ও কমন কার্প চাষ করুন।
- স্তরভিত্তিক মাছের সঠিক মজুদ ঘনত্ব মেনে চলুন।
- পুকুর/ ঘের/ জলাশয়েরগভীরতা বৃদ্ধি করুন এবং উত্তর-দক্ষিণমুখী আকৃতিতে পুকুর/ ঘের/ জলাশয়ের ডিজাইন করুন।
৬. তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস পাওয়া যাবে:
- তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া (সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন), ওয়েবসাইট, খুদে বার্তা (মোবাইল এসএমএস), সরকারি দপ্তরসমূহ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানা যাবে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য যাচাই-বাছাই করে নেয়া উচিত।
- তথ্য যাচাই করে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে পূর্বাভাস নিন।
তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় দ্রুত ব্যবস্থা নিন এবং যেকোনো সমস্যায় নিকটস্থ মৎস্য দপ্তরের পরামর্শ নিন।