১. ভূমিকা: বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বজ্রপাত একটি গুরুতর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যাপ্রবণ হাওর অঞ্চলসহ সমগ্র বাংলাদেশে মৎস্যজীবী ও মৎস্যচাষিদের জীবন-জীবিকা বজ্রপাতের কারণে চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। তাছাড়া, বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাতের সরাসরি আঘাত প্রাণঘাতী হতে পারে। সঠিক পূর্বাভাস, সচেতনতা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে এই ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব।
২. বজ্রপাতের বৈশিষ্ট্য এবং ঝুঁকি
২.১ বজ্রপাতের কারণ
- গ্রীষ্মকাল ও বর্ষায় উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশ বজ্রপাতের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে। বিশেষতঃ বৃষ্টির সময় জলীয় বাষ্পের ঘনত্ব এবং তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে বজ্রপাতের প্রবণতা বেড়ে যায়।
- উন্মুক্ত জলাশয় ও সমতল ভূমি: নদী, খাল, হাওর, বিল এবং সমতল ভূমি বজ্রপাতের প্রবণতা বাড়ায়।
- উচ্চতা: ফাঁকা মাঠ, উঁচু গাছ বা অবকাঠামো বজ্রপাতের আঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়।
২.২ বজ্রপাত ঘটার লক্ষণ
- আকাশ কালো হয়ে যাওয়া এবং ঘন মেঘের সৃষ্টি।
- বাতাসের তীব্রতা হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়া।
- বিদ্যুৎ চমকানো এবং বজ্রধ্বনি শোনা।
- বৃষ্টির আগে বা বৃষ্টির সময় অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়া।
৩. বজ্রপাতের পূর্বাভাস এবং তথ্য ব্যবস্থাপনা
৩.১ তথ্য পাওয়ার উৎস
- আবহাওয়া অধিদপ্তর: টেলিভিশন, রেডিও, ওয়েবসাইট এবং অ্যাপের মাধ্যমে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়া হয়।
- মোবাইল খুদে বার্তা: সরকারিভাবে এসএমএসের মাধ্যমে সতর্কবার্তা পাওয়া যায়।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য। তবে সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন।
৩.২ বজ্রপাতের সতর্কতা চিহ্নিত করার সময়কাল
- মার্চ থেকে জুন এবং সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি থাকে।
- বিশেষত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বজ্রপাতের পরিমাণ ও তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।
৪. বজ্রপাতের সময় মৎস্যজীবীদের করণীয়
৪.১ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা
- বজ্রপাতের পূর্বাভাস পেলে দ্রুত পানি থেকে উঠে শুকনো স্থানে আশ্রয় নিন।
- খোলা মাঠ, জলাশয় বা উঁচু স্থান এড়িয়ে চলুন।
- খোলা জায়গায় দলবদ্ধভাবে না থেকে পরস্পর হতে ৫০-১০০ ফুট দূরে অবস্থান করুন।
- খোলা জায়গায় থাকলে পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর করে দু-কানে আঙ্গুল দিয়ে বসে পড়ুন।
- মাটিতে শোয়া যাবে না। খোলা জায়গায় অবস্থান করলে পায়ের তলা দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ রাখতে এক পায়ের ওপরে আরেক পা তুলুন।
- ধাতব বস্তু ও ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি হতে দূরে থাকুন।
- বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোন, রেডিও, বা অন্য ধাতব বস্তু ব্যবহার করবেন না।
- ভেজা কাপড় দ্রুত পরিবর্তন করুন।
- অধিক পরিমাণে তাল, সুপারি ও নারকেল গাছ রোপণ করুন।
- বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপন করুন।
- বিদ্যুতের খুঁটি ও আশেপাশে থাকাটা অনিরাপদ, তবে দুটি খুঁটির মাঝে যদি পর্যাপ্ত দূরত্ব থাকে (যেমন ৩০-৫০ মিটার বা তার বেশি) তখন দুই খুঁটির ঠিক মাঝামাঝি জায়গা নিরাপদ।

- গাছের নিচে দাঁড়াবেন না, কারণ বজ্রপাত হলে বিদ্যুৎ গাছের কাণ্ড দিয়ে মাটিতে চলে আসে। তাই কাণ্ড বা শিকড় থেকে দূরে থাকবেন।
- গাছের চূড়া থেকে একটি কাল্পনিক রেখা কল্পনা করুন, যা ৪৫ ডিগ্রি কোণে ভূমির দিকে নেমে আসে। এই রেখা যেখানে মাটির সাথে মিলিত হয়, তার বাইরের জায়গাটি নিরাপদ। গাছের শিকড় যতদূর বিস্তৃত, সেই এলাকা এড়িয়ে চলুন। যদি গাছটি ১০ মিটার উঁচু হয়, তাহলে গাছের চূড়া থেকে ভূমি পর্যন্ত ৪৫ ডিগ্রি কোণে কল্পিত রেখা ১০ মিটার দূরে মাটির সাথে মিলিত হবে। তাই গাছ থেকে অন্তত ১০ মিটার দূরে থাকলেই আপনি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ থাকবেন।

৪.২ নৌকা বা ট্রলারে অবস্থানকালীন সতর্কতা
- বজ্রপাতের সময় নৌকা বা ট্রলারে থাকলে, মাঝনদী থেকে তীরবর্তী নিরাপদ স্থানে চলে যান।
- নৌকার নিচে বা কাঠের পাটাতনে বসে থাকুন।
- নৌকার কোনো ধাতব অংশ স্পর্শ করবেন না।
- বজ্রপাতের সময় বৈঠা বা কোনো ধাতব যন্ত্রপাতি ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।
- বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র (লাইটেনিং অ্যারেস্টর) নৌকায় মজুদ রাখতে হবে।
৪.৩ মাছ ধরার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সময় সতর্কতা
- বজ্রপাতের সময় জাল, ফাঁদ বা অন্যান্য ধাতব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করবেন না।
- বজ্রপাতের মৌসুমে বজ্রনিরোধক জাল ব্যবহার করুন।
৫. বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে মৎস্যচাষিদের করণীয়
- পুকুরপাড়ে বজ্র নিরোধক যন্ত্র স্থাপন।
- পুকুরের আশপাশে ধাতব যন্ত্রপাতি বা বৈদ্যুতিক তার থাকলে তা সরিয়ে ফেলুন।
- বজ্রপাতের মৌসুমে মাছের খাদ্য সরবরাহের জন্য স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের পরিবর্তে হাতের সাহায্যে খাদ্য দিন।
- বজ্রপাতকালীন পুকুরের মাছ আহরণ হতে বিরত থাকা এবং পুকুরের পানির সংস্পর্শে না যাওয়া।
- পুকুর ও ঘেরের পাড়ে অবস্থিত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে।
- বিদ্যুৎ অপরিবাহী রাবার জুতা বা গামবুট ব্যবহার করতে হবে।
- বজ্রপাতের সময় ঘরে অবস্থান করতে হবে। যদি পুকুর ও ঘেরের পাড়ে অবস্থান করেন তাহলে দ্রুত ছাউনীর নিচে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে।
৬. বজ্রপাত পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম
- ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ: পুকুর, ঘের এবং অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করুন।
- পুকুরের পানি শোধন: বজ্রপাতের পর জীবাণুনাশক প্রয়োগ করে পানি শোধন করুন।
- মাছের মজুদ: পোনা মাছ পুনরায় মজুদ করুন এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করুন।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: বজ্রপাতের ঝুঁকি এবং করণীয় সম্পর্কে স্থানীয় মৎস্যজীবী ও চাষিদের সচেতন করুন।
৭. উপসংহার: বাংলাদেশের মৎস্যজীবী ও মৎস্যচাষিরা বজ্রপাতের সঠিক পূর্বাভাস এবং সতর্কতা মেনে চললে নিজেদের এবং তাঁদের জীবিকা সুরক্ষিত রাখতে পারবেন। সচেতনতা, পুকুরের সুরক্ষা, এবং বজ্রপাত পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। সরকারি সহায়তা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিশ্চিত করা গেলে এ সমস্যা আরও কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।