শৈতপ্রবাহ: মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীদের জন্য আগাম প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থাপনা পরামর্শ

১. ভূমিকা: শৈতপ্রবাহ বাংলাদেশের মৎস্য খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায় এবং এ সময়ে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার নিচে নেমে আসতে পারে। এই সময়ে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে মাছের স্বাভাবিক জীবনচক্র ও মৎস্যচাষ প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। মাছের স্বাস্থ্য, বৃদ্ধি ও প্রজননে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রায় সংকট দেখা দেয়। শৈতপ্রবাহ মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি, সঠিক তথ্য প্রচার এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব।

 

২. শৈতপ্রবাহের প্রভাব চিহ্নিতকরণ

২.১ খামার ও চাষকৃত প্রজাতির ওপর প্রভাব

  • শৈতপ্রবাহের সময় পুকুর ও ঘেরের পানির তাপমাত্রা যথেষ্ট কমে যায়।
  • মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগের প্রকোপ বাড়ে।
  • খাদ্য গ্রহণ কমে যায় ও মাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
  • পানির তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে মাছের বিপাক ক্রিয়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

 

২.২ মৎস্যজীবীদের কার্যক্রমে প্রভাব:

  • শৈতপ্রবাহের কারণে মাছ ধরার কার্যক্রম কমে যায় বা সীমিত হয়ে পড়ে।
  • শৈতপ্রবাহে মাছ কম সক্রিয় থাকায় জালে মাছ ও চিংড়ি অপেক্ষাকৃত কম আহরিত হয়।
  • ঠান্ডা আবহাওয়ায় নদী, হাওর ও অন্যান্য জলাশয়ে মাছ ধরতে গিয়ে শারীরিক ঝুঁকি বাড়ে।
  • শৈতপ্রবাহে দীর্ঘ সময় ধরে পানিতে থাকার কারণে নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।

 

৩. শৈত্যপ্রবাহ পূর্বাভাস এবং তথ্য ব্যবস্থাপনা

শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া যায়, যেমন: আবহাওয়া অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন, সোস্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন, রেডিও এবং পত্রিকা। এই পূর্বাভাসের মাধ্যমে শৈত্যপ্রবাহ মোকাবিলায় যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব। পূর্বাভাসে নিম্নোক্ত তথ্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

– তাপমাত্রার সর্বনিম্ন মান এবং তাপমাত্রার তারতম্যের পরিসীমা।

– শৈতপ্রবাহের সম্ভাব্য স্থায়িত্বকাল।

– সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় এবং বাতাসের আর্দ্রতার মাত্রা।

এই তথ্যগুলোর সঠিক বিশ্লেষণ মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীদের কার্যকর প্রস্তুতি গ্রহণে সাহায্য করে এবং শৈত্যপ্রবাহের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা করে।

৪. শীতকালীন মাছ চাষ সতর্কতা

৪.১ পানি, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা

  • শীতের শুরুতে সংশ্লিষ্ট মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শক্রমে পুকুর ও ঘেরে পরিমাণমত চুন এবং লবণ প্রয়োগ করতে হবে।
  • শৈত্য প্রবাহ হলে সমস্ত পুকুরে পলিথিন শেড দেয়া যেতে পারে। ফলে পুকুর ও ঘেরের পানিতে বাইরের ঠান্ডা তাপমাত্রার প্রভাব কমবে।
  • সম্ভব হলে গভীর নলকূপের পানি সরবরাহ করে পুকুরে পানির গভীরতা ৫-৭ ফুট রাখতে হবে।
  • পুকুরের তলদেশে ক্ষতিকর গ্যাস দূর করার জন্য মাসে অন্তত ২ বার সূর্যের আলো থাকাকালীন সকাল ১০ টা হতে দুপুর ১২ টার মধ্যে সাবধানতার সাথে হররা টানতে হবে এবং পুকুর ও ঘেরে জাল টানা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • পানির গুনাগুণ ও মাছের স্বাস্থ্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পানির গুনাগুণ ভালো রাখা, ক্ষতিকর গ্যাস দূর করা, খাল বিলের পানি পুকুর ও ঘেরে প্রবেশ না করানোসহ অন্যান্য জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
  • পানির উপরের স্তরে সবুজ বা লাল স্তর পড়লে তা খড়ের দড়ি ও কাপড়ের মাধ্যমে সরিয়ে ফেলতে হবে।
  • পুকুর ও ঘেরের পাড়ে গাছপালা থাকলে ডালপালা কেটে পর্যাপ্ত সূর্যালোক যাতে পুকুরের পানিতে পড়ে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
  • অক্সিজেন স্বল্পতা থাকলে অ্যারেটর চালানো বা অক্সিজেন ট্যাবলেট প্রয়োগ কিংবা অন্য কোন পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪.২ খাদ্য এবং মজুদ ব্যবস্থাপনা

  • মাছের খাদ্য স্বাভাবিকের চেয়ে কম প্রয়োগ করতে হবে। তবে শৈত প্রবাহকালীন (তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে) খাবার ও সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
  • মাছের মজুদ ঘনত্ব কমাতে শীতের শুরুতে বড় আকারের মাছ আংশিক আহরণ করতে হবে এবং নতুন করে পোনা মজুদ থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • যদি অন্য পুকুরে মাছ স্থানান্তরের সুযোগ থাকে সেক্ষেত্রে ছোট আকারের মাছগুলোকে স্থানান্তর করতে হবে এবং বড় আকারের মাছকে বিদ্যমান পুকুরে আরো বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
  • মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ও ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভিটামিন সি, মিনারেলস, বিটা গ্লুকান এবং উপর্যুক্ত মানের প্রোবায়োটিক ও প্রিবায়োটিক নির্ধারিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।

 

৫. শৈত্যপ্রবাহ পরবর্তী  পরিকল্পনা

  • সঠিক মাত্রায় চুন, লবণ ও জীবাণুনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
  • পানির বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক প্যারামিটার (pH, তাপমাত্রা, অক্সিজেন ইত্যাদি) পরীক্ষা করতে হবে।
  • অক্সিজেন বাড়ানোর জন্য অ্যারেটর ব্যবহার বা পানির ওপরিভাগে পানি প্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে।
  • যথাযথ মাত্রায় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করে পানির গভীরতা বৃদ্ধি করতে হবে।
  • মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রিবায়োটিক ও প্রোবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে।
  • পানির গুণমান বজায় রাখতে নিয়মিত চুন প্রয়োগ করতে হবে।
  • নির্দিষ্ট সময় অন্তর মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
  • ছায়ার কারণে যাতে পানির তাপমাত্রা অতিরিক্ত না কমে সেজন্য পুকুর পাড়ে বড় গাছপালা অপসারণ করতে হবে।

 

উপসংহার: শৈত্যপ্রবাহ মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি মৎস্য খাতের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সাহায্য করতে পারে। মৎস্যজীবী ও মৎস্যচাষিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং নির্ধারিত পরামর্শ মেনে চললে মাছের উৎপাদন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। সকলে মিলে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শৈত্যপ্রবাহের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করা যাবে।

সতর্ক থাকুন, প্রস্তুত থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন।

শৈত্যপ্রবাহ মোকাবিলায় সকলে মিলে কাজ করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *