১. ভূমিকা: বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চল ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হয়, যা মৎস্যজীবী ও মৎস্যচাষিদের জীবিকা এবং মাছ/ চিংড়ি চাষের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে পুকুর ও ঘেরের কাঠামোগত ক্ষতি, পানির গুণগত মান নষ্ট হওয়া, মাছ/ চিংড়ির উৎপাদন ও প্রজননে ব্যাঘাত ঘটাসহ নৌকা ও মাছ ধরার সরঞ্জামের ক্ষতি হয়ে থাকে। এর প্রভাবে মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীদের জীবন ও জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাই ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বে যথাযথ প্রস্তুতি এবং ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
২. ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব চিহ্নিতকরণ
২.১ পুকুর/ ঘেরের পানির গুণগত মানের ওপর প্রভাব:
- ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশেপাশের গাছপালা পুকুর/ ঘেরে ভেঙে পড়ে, এতে গাছপালা পঁচে পানির গুনাগুণ নষ্ট হওয়াসহ দূষণ ঘটে।
- ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পুকুর/ ঘেরের পানির স্তর ওঠানামা এবং দূষিত পানি প্রবেশ করার ফলে পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণের অবনতি ঘটে।
- সূর্যালোকের উপস্থিতি কমে যায় এবং বিভিন্ন জৈবিক ও রাসায়নিক পদার্থ পানিতে মিশে ঘোলাত্ব ও দূষণ বাড়ায়, যার ফলে প্রাকৃতিক খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়।
২.২ পুকুর, ঘের এবং মাছ/ চিংড়ির খাবারের মজুতের ক্ষতি
- পুকুর বা ঘেরের পাড়/বাঁধ ভেঙে যায়।
- পুকুর বা ঘেরের অবকাঠামো নষ্ট হয়।
- পুকুর বা ঘেরের বৈদ্যুতিক সংযোগসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
- বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙ্গে গিয়ে পুকুর বা ঘেরের পানি বিদ্যুতায়িত হয়ে মাছ/ চিংড়ি মারা যেতে পারে তাই এসময় খামারের কেন্দ্রীয় সুইচ বন্ধ রাখতে হবে।
২.৩ মাছ/ চিংড়ি চাষ এবং উৎপাদনের ওপর প্রভাব:
- পুকুর/ ঘেরের পাড় ভেঙে গিয়ে মাছ বের হয়ে যেতে পারে।
- চাষকৃত পুকুর/ ঘেরের পাড় ভেঙে যাওয়ায় অবাঞ্চিত ও রাক্ষুসে মাছ ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণি পুকুর/ ঘেরে প্রবেশ করে।
- ঘূর্ণিঝড়ের আকস্মিকতার কারণে ঝুঁকি এড়ানো কঠিন, ফলে উৎপাদন কমে যায়।
২.৪ মাছ/ চিংড়ি ধরার যন্ত্রপাতি ও নৌকার নিরাপত্তা ঝুঁকি
- নৌকা ভেঙে যেতে পারে, ডুবে যেতে পারে, হারিয়ে যেতে পারে।
- নৌকার ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
- মাছ ধরার জাল ছিঁড়ে বা হারিয়ে যেতে পারে।
- মাছ ধরার নৌকা ও যন্ত্রপাতি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
২.৫ মৎস্য/ চিংড়ি চাষি এবং মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রা ও জীবিকার ওপর প্রভাব
- বাড়িঘর এবং সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ঘটে।
- পরিবারে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
- বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায়।
- পুঁজির অভাবে পরবর্তী চাষ কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়
- মাছ আহরণের সুযোগ কমে যাওয়ায় ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পায়।
৩. ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস এবং তথ্য উৎস্য
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট, টেলিভিশন, রেডিও, এবং মোবাইল বার্তার মাধ্যমে পাওয়া যায়। এই পূর্বাভাসে বাতাসের গতি, পানির উচ্চতা এবং ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য সময়কাল সম্পর্কে তথ্য মৎস্যজীবী ও মৎস্য চাষিদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বাভাসের তথ্য দ্রুত মৎস্যচাষি/মৎস্যজীবীদের কাছে পৌঁছাতে মাইকিং, মোবাইল মেসেজ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহারের পাশাপাশি স্থানীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক যোগাযোগের ওপর জোর দিতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বা পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথে মৎস্যসম্পদ রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া, নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ প্রাণীদের জন্য নিরাপত্তার সুব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ১০৯০ নম্বরে ফ্রি ফোন করে ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা জানুন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।
৪. ঘূর্ণিঝড় পূর্ব প্রস্তুতি এবং ঝুঁকি মোকাবিলায় করণীয়:
৪.১ পুকুর/ ঘেরের মাছ ও চিংড়ি সুরক্ষিত রাখা:
- পুকুর/ ঘেরের পাড় উঁচু ও মজবুত করাসহ জাল (টায়ার কর্ডের জাল) বা বানা দিয়ে ঘিরে রাখুন।
- পুকুর/ ঘেরে কাঁঠা বা ঝোঁপঝাড় স্থাপন করুন।
- প্রয়োজনে পুকুর/ ঘেরের মাছ নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর বা মাছের আংশিক আহরণ করুন।
- পুকুর/ ঘেরের পাড়ে বড় গাছপালা না রাখা অথবা বড় গাছপালা থাকলেও ডালপালা কেটে দিতে হবে।
- মৎস্য ও চিংড়িচাষ ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পরামর্শ সেবার জন্য অফিস চলাকালীন সময়ে ১৬১২৬ হটলাইন নম্বরে ফোন করুন।
- নিকটস্থ মৎস্য অফিস ও অন্যান্য সেবাদানকারী সংস্থার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন।
- পুকুরের পাড়ে প্যালাসাইটিং করা।
- পাড়ের ঢাল সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা।
- পাড়ের উপরের অংশ কমপক্ষে ৫ ফুট রাখা।
- পুকুর পাড়ে দূর্বাঘাস লাগাতে হবে।
৪.২ মাছের খাবার এবং সরঞ্জাম সুরক্ষিত রাখা
- খাবার সংরক্ষণের গুদাম পাকা ও মজবুত করা।
- খাবারগুলো পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা।
- প্রয়োজনের অধিক খাবার সংরক্ষণ না করা।
- মাছ ও চিংড়ির খাদ্য মেঝে থেকে উঁচু স্থানে কাঠের পাটাতনের উপর রাখতে হবে।
- খামারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিরাপদ স্থানে সুরক্ষিত রাখা।
৪.৩ মৎস্যচাষি, মৎস্যজীবী ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- ঘূর্ণিঝড় ও সাইক্লোনের পূর্বাভাস পাওয়া মাত্র গভীর সমুদ্রে না গিয়ে নৌকা, ট্রলারসমূহ ও মাছ ধরার সরঞ্জামাদি নিরাপদ স্থানে রাখুন।
- ঘূর্ণিঝড় ও সাইক্লোন চলাকালীন মৎস্যজীবীগণ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাছ ধরা থেকে বিরত থাকুন এবং নিজেদের জান-মাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকুন।
- মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীদের আগাম বার্তা প্রদান করুন।
- ঘূর্ণিঝড়/ সাইক্লোন চলাকালীন নিকটস্থ সাইক্লোন সেন্টারে অথবা নিরাপদ স্থানে অবস্থান করুন।
- নারী ও শিশুদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা নিন।
- লাইফ জ্যাকেট এবং প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ঔষধ সাথে রাখতে হবে।
- ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুন।
৫. ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা
৫.১ পুকুর বা ঘেরের পানির গুণগত মান পরীক্ষা এবং পুনরুদ্ধার
- পুকুর/ ঘেরের পানির গুনাগুণ (DO, pH, NH3 ইত্যাদি) মাপা ও প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।
- পুকুর/ ঘের থেকে গাছের পাতা, ডালপালা এবং অন্যান্য আবর্জনা অপসারণ করা।
- সঠিক মাত্রায় চুন, লবণ ও জীবাণুনাশক প্রয়োগ করা।
৫.২ ক্ষতিগ্রস্ত মাছের প্রজাতি এবং তাদের স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার
- ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন পুকুরে খাবার সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা।
- পুকুর/ খামারে অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণে অ্যারেটর ব্যবহার করা। অ্যারেটর ব্যবহার যদি সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে অক্সিজেনের ঘাটতি মোকাবিলায় অক্সিজেন ট্যাবলেট (প্রতি শতকে প্রতি ফুট পানির গভীরতায় ১টা করে অক্সিজেন ট্যাবলেট) অথবা নির্দেশিত মাত্রায় অক্সিজেন পাউডার ব্যবহার করা।
৫.৩ পুকুর বা বাঁধ পুনর্গঠনে প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং সহায়তা
- বাঁশ, জিওব্যাগ, কংক্রিট ব্লক ইত্যাদি সরবরাহ করা।
- সমবায়ের ভিত্তিতে স্বেচ্ছাশ্রমে চাষিদের অংশগ্রহণে পুনর্গঠন কার্যক্রম পরিচালনা করা।
- পুকুর পাড়ে দুর্বাজাতীয় ঘাস লাগিয়ে প্রাকৃতিকভাবে পাড়কে টেকসই করা।
৬. মৎস্যজীবী ও মৎস্য চাষিদের পুনর্বাসনে সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা
- প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের তালিকা প্রণয়ন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহায়তা প্রদান করা।
- সাইক্লোন পরবর্তী মজুদের জন্য পোনার উৎস্য নিশ্চিত করা।
- সমবায়ের ভিত্তিতে আত্মকর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
- প্রাকৃতিক জলাশয়সমূহে নার্সারি স্থাপন এবং পোনামাছ অবমুক্ত করতে হবে।
- মৎস্যচাষি/মৎস্যজীবীদের মতামত এবং পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তী পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।
৭. উপসংহার: ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৎস্যজীবী ও মৎস্য চাষিদের জীবন ও জীবিকার ক্ষতি এড়াতে সঠিক প্রস্তুতি, কার্যকর পূর্বাভাস, এবং দ্রুত পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সকল পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ এবং সচেতনতার মাধ্যমে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। ঘূর্ণিঝড়সহ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ কমাতে বনায়ন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষের হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকা এবং ক্ষতিগ্রস্থ পরিবেশ পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরী।
জলাশয়ে মৎস্য আহরণের সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলদস্যুদের হামলায় অথবা বাঘ ও অন্যান্য হিংস্র জলজ প্রাণীর আক্রমণে নিবন্ধিত জেলে নিহত, নিখোঁজ অথবা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলে পরিবারকে “জেলেদের আর্থিক সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০১৯” এর আলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে।