বন্যাপ্রবণ মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীদের জন্য আগাম সতর্কতা এবং পরামর্শ

১. ভূমিকা

বাংলাদেশে বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা ও উৎপাদনশীলতা ঝুঁকিতে থাকে। সঠিক পূর্বাভাস এবং যথাযথ পূর্ব প্রস্তুতির মাধ্যমে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এই পরামর্শপত্র অনুসরণ করে বন্যাপ্রবণ এলাকার মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীরা ঝুঁকিমুক্ত চাষাবাদ এবং টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারবেন।

 

২. বন্যার পূর্বাভাস এবং তথ্য ব্যবস্থাপনা 

বন্যাপ্রবণ এলাকায় মৎস্য চাষিদের জন্য বন্যার পূর্বাভাসের সময়কাল, ব্যাপ্তি এবং নদীর পানির উচ্চতা জানা গুরুত্বপূর্ণ।

এসব তথ্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল খুদে বার্তা এবং সরকারি দপ্তর (আবহাওয়া অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড) থেকে পাওয়া যায়।

তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া তথ্য যাচাই করে নেওয়া উচিত।

 

৩. বন্যার প্রভাব চিহ্নিতকরণ

৩.১ মাছ ও চিংড়ির ওপর প্রভাব

  • পানি দূষিত হয়।
  • পানির ঘোলাত্ব বেড়ে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি ব্যাহত হয়।
  • রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি।
  • মাছ ও চিংড়ির নিরাপদ আশ্রয়স্থল কমে যায়।
  • নার্সারি, বিচরণ এবং প্রজনন ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্থ ও পরিবর্তিত হয়।
  • অক্সিজেন ঘাটতির কারণে মাছ ও চিংড়ির বৃদ্ধি কমে যায়।
  • ফুলকায় মাটি প্রবেশ করে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হওয়ার পাশাপাশি মাছ ও চিংড়ির মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হয়।

৩.২ মৎস্যজীবী ও চাষিদের প্রধান সমস্যা:

  • মাছ ও চিংড়ি আহরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
  • মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীদের পরিবারে খাদ্য সংকটসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়।
  • চাষকৃত মাছ ও চিংড়ি ভেসে গিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়।
  • পুকুর ও ঘেরের জৈব নিরাপত্তা ব্যাহত হয়।
  • মাছ ও চিংড়ির খাদ্য বা খাদ্য তৈরির উপকরণ নষ্ট হয়।
  • রাক্ষুসে মাছ ও অন্যান্য প্রাণি পুকুর ও ঘেরে প্রবেশ করার সম্ভাবনা থাকে।
  • মৎস্যজীবীদের আহরিত মাছ ও চিংড়ি পরিবহণ এবং বাজারজাতকরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।

৩.৩ যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোর ক্ষতি:

  • স্থাপনা ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
  • মাছ ধরার যন্ত্রপাতি (নৌকা, জাল) ভেসে যায়।
  • ঘের ও পুকুরের পাড় ভেঙে যায়।
  • আধুনিক খামারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি (অ্যারেটর, অটো ফিডার, সেচ পাম্প) নষ্ট হয়ে যায়।

৩.৪ পানির প্রবাহ ও দূষণের প্রভাব:

  • পানির ঘোলাত্ব বেড়ে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন কমে যায়।
  • মাছ ও চিংড়ির বৃদ্ধি কমে যায়।
  • অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় এবং অ্যামোনিয়া ও নাইট্রেটের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
  • কৃষি জমি থেকে আগত রাসায়নিক পদার্থ পুকুর ও ঘেরের পানি নষ্ট করে।

৪. বন্যাপ্রবণ এলাকায় মাছ ও চিংড়ি চাষের পরামর্শ

৪.১ সঠিক প্রজাতি নির্বাচন:                                                            

  • বন্যাপ্রবণ এলাকায় বন্যা হওয়ার সময় মাথায় রেখে দ্রুত বর্ধনশীল, চাষকালীন সময় কম এবং অল্প সময়ে বাজারজাত উপযোগী এমন মাছ ও চিংড়ি, যেমন – তেলাপিয়া, কৈ, শিং, মাগুর, সরপুঁটি, কমন কার্প, পাঙ্গাস, ভেনামি চিংড়ি ইত্যাদি মজুদ করতে হবে।।
  • ছোট মাছ মজুদ না করে বড় আকারের (যেমন: কার্প জাতীয় মাছ কেজিতে ৩-৪ টা) মাছ মজুদ করতে হবে।

৪.২ পুকুর, পানির গুনাগুণ এবং মাছ ও চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষা:

  • পুকুর ও ঘেরের পাড় উঁচু এবং পাড় খাড়াভাবে না করে ১:২ ঢাল রেখে পাড় তৈরী করতে হবে।
  • পুকুর ও ঘেরের চারপাশে বেড়া বা ভালোভাবে নেটিং (টায়ার কর্ডের জাল ব্যবহার করা উত্তম) করে চারদিকে বেষ্টনী তৈরি করতে হবে।
  • বন্যার পূর্বাভাস থাকলে আংশিক আহরণের মাধ্যমে বিক্রয়যোগ্য মাছসমূহ বিক্রয় করতে হবে।
  • বন্যার পূর্বাভাস থাকলে মজুদকৃত মাছ পুকুর বা ঘেরের মধ্যে বড় আকৃতির হাঁপার মধ্যে মজুদ করা যেতে পারে।
  • পুকুর ও ঘেরের মাঝে গুল্ম ঝোঁপঝাড় দিয়ে আশ্রয়স্থল তৈরী করতে হবে।
  • আয়তন ও গভীরতা ভেদে নির্দিষ্ট সময় পরপর সঠিক মাত্রায় চুন ও লবণ প্রয়োগ করতে হবে।
  • পুকুরের ইনলেট ও আউটলেট ব্যবস্থা মজবুত রাখতে হবে।
  • জিআই ব্যাগ/জাল দিয়ে পুকুর ও ঘেরের পাড় ঢেকে রাখতে হবে।
  • পুকুর পাড়ে সবজি রোপন করা যেতে পারে।
  • বন্যার পানি প্রবেশ করলে জীবাণুনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
  • লাইফ জ্যাকেট এবং প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ঔষধ সাথে রাখতে হবে।
  • ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুন।

৪.৩ খাদ্য ব্যবস্থাপনা:

  • সঠিক মাত্রায় (দৈনিক দুই বা তিনবেলা) নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
  • খাদ্য সরবরাহের জন্য বন্যার সময় খুঁটির সাহায্যে বস্তায় খাবার সেট করে রাখা যেতে পারে। যেমন-কার্প জাতীয় মাছের খামারের বিভিন্ন স্থানে খৈলের বস্তা বেধেঁ রাখা যেতে পারে।
  • বাজারের ফরমুলেটেড খাবার প্রয়োগ করতে হবে।
  • মাছ ও চিংড়ির খাদ্য পাটাতনের উপর রাখতে হবে।

৫. পুনর্বাসন:

  • পাড় মেরামতপূর্বক পুকুর পাড়ে দূর্বাঘাস লাগাতে হবে।
  • সম্ভাব্য ক্ষেত্রে আংশিক পানি পরিবর্তন করতে হবে।
  • পুকুর ও ঘেরের পানির গুনাগুণ (DO, pH, NH3) পরীক্ষা করা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • পানি জীবাণুমুক্তকরণ।
  • প্রাকৃতিক উৎপাদন নিশ্চিতকল্পে নার্সারি স্থাপন এবং পোনামাছ অবমুক্ত করতে হবে।
  • জাল টেনে মজুদকৃত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে।
  • পুকুর ও ঘেরে পুনরায় মজুদ করার নিমিত্ত পোনামাছ ও চিংড়ির পিএল-এর উৎস্য সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।
  • সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়পূর্বক উপজেলা/জেলা মৎস্য দপ্তরকে অবহিত করতে হবে।

উপসংহার: বন্যাপ্রবণ এলাকার মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীগণ যথাযথ পূর্বাভাস ও প্রস্তুতির মাধ্যমে তাঁদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারেন। সঠিক প্রজাতি নির্বাচন, পুকুর ও ঘেরের নিরাপত্তা এবং পানির গুণাগুণ রক্ষার পদক্ষেপগুলো মৎস্য ও চিংড়ি চাষে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন নিশ্চিত করা গেলে মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীগণ তাঁদের জীবন-জীবিকা আরও সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *